Popunder

ads top

আহ্‌, সেই ফেরাউন-যুগ! কী জ্ঞানের রহস্য লুকিয়ে আছে মহাকালের সেই পৃষ্ঠাগুলোয়? কবে জানবো আমরা?

 

১৯৭৮ সালের শুরুতে, জাপানের একটি গবেষক-দল মিশরে গিয়ে উপস্থিত হলেন, একটি পিরামিড বানানোর উদ্দেশ্য নিয়ে। তাঁরা এর আগের বেশকিছু দিন ধরে নানান গবেষণা শেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন─ প্রাচীন মিশরীয় ফেরাউনরা যেসব প্রাচীন পদ্ধতিতে পিরামিড তৈরি করেছেন বলে ধারণা করে আসছেন বিজ্ঞানীরা, ঠিক সেই পদ্ধতিই, আজকের আধুনিককালের কোনো যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি, জ্ঞান প্রয়োগ না-করে, হুবুহু একটি পিরামিড নির্মাণের। অর্থাৎ, সেই পরীক্ষা বা এক্সপেরিমেন্টে, পিরামিড তৈরির পাথরের বর্গাকৃতি ব্লকগুলো বানানো হবে ছেনি বা বাটালি দিয়ে কেটে, পাথরগুলো আনা হবে মানুষের হাতে টেনে, এবং সেগুলো দিয়ে পিরামিডের দেয়াল নির্মাণের করার সময় একটির উপর আরেকটি তোলা হবে দড়ি ও মানুষের হাত-কাঁধের সাহায্যে। ঠিক যেন ফেরাউন-কালের সেই প্রাচীন মিশর!
জাপানের একটি ব্রডকাস্টিং চ্যানেল─ 'জাপানিজ টিভি'─ এই এক্সপেরিমেন্টে অর্থায়নের পুরো দায়িত্ব নিলো, একটি শর্তে─ পুরো পরীক্ষাটি আগাগোড়াই ধারণ করবে 'জাপানিজ টিভি' এবং সেটি নিয়ে একটি ডক্যুমেন্টারি তৈরি ও প্রচার করবে তারা। জাপানি বিশেষজ্ঞরা সিদ্ধান্ত নিলেন─ পরীক্ষাটি তাঁরা করবেন 'গিজা' এলাকাতে, গিজা'র বিখ্যাত 'দ্য গ্রেট পিরামিড'-এর পাশে। মিশরের সরকারের সাথে চুক্তি করা হলো─ নির্মিত পিরামিডটি 'এক্সপেরিমেন্ট' শেষে সম্পূর্ণ সরিয়ে ফেলা হবে, এবং স্থানটিকে পরিষ্কার করে সম্পূর্ণ পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কাজ আরম্ভ হলো; প্রায় ৫ হাজার বছর পুরনো পিরামিডের পাশে সম্পূর্ণ একটি নতুন পিরামিড তৈরির কাজ, পুরোপুরি প্রাচীন কন্সট্রাকশন পদ্ধতিতে।
প্রাথমিক পরিকল্পনায় সিদ্ধান্ত হলো─ ২০ মিটার উঁচু একটি পিরামিড তৈরি করা হবে (জেনে রাখা প্রয়োজন─ 'দ্য গ্রেট পিরামিড' ১৪৬.৫ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন; এবং, পিরামিডের দুয়ার পাহারাদার স্ফিংক্সই ২০ মিটার উঁচু), যার বাইরের দেয়ালের গায়ে সিঁড়ি (টেরেস) থাকবে স্বাভাবিক পিরামিডের মতোই, এবং এটি তৈরি করার জন্য প্রত্যেকটি পাথরের টুকরা বা ব্লকের ওজন হবে ৪ টন (জেনে রাখি─ অধিকাংশ পিরামিডের পাথরের টুকরো বা ব্লকগুলোর প্রত্যেকটির ওজন ২৫ টন, এবং সর্বাধিক ওজনের ব্লকটি ৮০ টনের, এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্লক সহ সমস্ত ব্লকের গড় ওজন ২.৫ টন)। যাইহোক, ১০০ মিশরীয় শ্রমিককে, যাঁদের অধিকাংশই স্থানীয় শক্তসমর্থ কৃষক, বাছাই করে, দৈনিক সাড়ে ৫ মার্কিন ডলার মজুরিতে, সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত শ্রমদানের চুক্তিতে, এই কাজে নিযুক্ত করা হলো। তাঁদের জন্য বরাদ্দ করা হলো দৈনিক দুপুরের খাবার ও বিকেলের কফি-ব্রেক।
১৯৭৮ সালের জাপানের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রযুক্তিতে জ্ঞানী ও মেধাবী গবেষকেরা, যাঁদের বুদ্ধি, মেধা, বিবেচনা, শিক্ষা, ব্যাখাবিশ্লেষণ-পদ্ধতি হাজার বছরের পুরনো জ্ঞানের তুলনায় অবশ্যই উন্নত, সেই তাঁরা, ৫,০০০-এর বেশি বছরের পুরনো নির্মাণ-পদ্ধতিতে একটি পিরামিড তৈরি করতে গিয়ে, শুরুতেই এমন সব অদ্ভুত সমস্যার সম্মুখীন হলেন, যা তাঁদের ধারণাতেও ছিল না!
দেখা গেলো─ বাটালি বা ছেনি ও হাতুড়ি ব্যবহার করে একেকটি ৪ টন ওজনের পাথরের বর্গাকৃতির ব্লক বানানো ভয়ানক কঠিন একটি কাজ! এবং, এ-কাজে খরচ হয়ে যাচ্ছে প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি সময় ও খরচ! অতএব, তাঁরা সিদ্ধান্তকৃত ২০ মিটার উচ্চতার পিরামিডকে নামিয়ে আনলেন ঠিক অর্ধেকে─ ১০ মিটার উঁচু পিরামিড বানাবেন তাঁরা। এবং, প্রত্যেকটি পাথরের ব্লকের ওজন ৪ টন থেকে নামিয়ে আনলেন─ ১ টনে। এর চেয়েও লজ্জার ও অক্ষমতার ব্যাপারটি হলো─ পাথর-কাটায় তাঁরা ব্যবহার করতে আরম্ভ করলেন আধুনিক 'ইলেক্ট্রিক করাত', যা কথা ছিল না; কথা ছিল─ সম্পূর্ণ প্রাচীন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেই তৈরি করা হবে পিরামিডটি। এবং, এই ইলেক্ট্রিক করাতের ব্যবহারই বুঝিয়ে দিলো─ সেই ৫ হাজার বছর আগের ফেরাউনদের প্রাচীন যন্ত্রপাতি আমাদের আধুনিক যন্ত্রপাতির তুলনায় কতোটা উন্নততর ছিলো, যা দিয়ে তৈরি করে ফেলা হয়েছিলো বিশালতম 'দ্য গ্রেট পিরামিড'!
এরপর, গবেষক দল দেখতে পেলো─ কাজের প্রত্যেকটি ধাপেই তাঁরা ব্যর্থ হচ্ছেন; যেমন─ 'তোরা' এলাকা থেকে (ইতিহাসবিদ ও বিজ্ঞানীদের মতে─ যে-স্থান থেকে পাথর এনে গিজায় বানানো হয়েছিলো পিরামিড) নীলনদ হয়ে 'গিজা' এলাকায় পাথরের ব্লকগুলো নিয়ে আসা, পাথরগুলোকে গাছের ভেলা বা নৌকায় তুলে নদী পার করানো, ইত্যাদি কাজে, বলতে গেলে বারেবার ব্যর্থই হয়ে চলেছেন তাঁরা! ভয়ানক অমানুষিক এ পরিশ্রম! ফলে, তাঁরা, দ্বিতীয়বারের মতো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে বাধ্য হলেন─ ফেরি; সমতল জলযান বা ফ্ল্যাট শিপ, পাথরের ব্লক পারাপারের জন্য।
এরপরে দেখা দিলো আরেক বিপত্তি─ ফেরি সহযোগে পাথরগুলোকে যখন নদীতীরে আনা হলো, দেখা গেলো ৫০ জন শ্রমিক মিলেও ১ টনের একটি পাথরকে অল্প কয়েক সেন্টিমিটারের বেশি নিয়ে যেতে পারছে না! যার অর্থ দাঁড়ালো─ এভাবে চললে, পাথরগুলোকে শুধুমাত্র নীল নদের তীর থেকে পিরামিড তৈরির স্থানে─ প্রায় ৫৪৫ মাইল বা ৮৭৫ কিমি দূরত্বের এই পথ পেরিয়ে─ নিয়ে যেতেই তাঁদের লেগে যাবে অনেক বছর! তাহলে? পরীক্ষাটি শেষ করতে, অর্থাৎ পিরামিডটি নির্মাণ সম্পন্ন করতে কতো সময় লাগবে? অতএব, তাঁদেরকে সাহায্য নিতে হলো তৃতীয় আধুনিক প্রযুক্তির─ বানাতে হলো রেলপথ, নদীতীর হতে পিরামিড তৈরির স্থান পর্যন্ত; যে-পথ দিয়ে লৌহ-নির্মিত ছোটছোট মালবাহী গাড়িতে তুলে একটি করে ব্লক নিয়ে যাওয়া হবে। অথচ, পিরামিড তৈরির কালে চাকা আবিষ্কৃত হয়নি!
পাথর পরিবহণের মারাত্মক এই সমস্যাটি দেখে, গবেষকেরা স্বাভাবিকভাবেই বুঝে গেলেন─ এই পাথরগুলোকে মাটি থেকে একটার উপর একটা তুলে পিরামিডের দেয়াল বানাতে কীরকম ঝামেলা পোহাতে হবে তাঁদের, এবং এভাবে পিরামিডের ভিতরের কক্ষগুলো তৈরি করার ভাবনাটি তাঁদের অন্তর কাঁপিয়ে দিলো! ফলশ্রুতিতে, তাঁরা সহায়তা নিলেন আরেকটি আধুনিক প্রযুক্তির─ স্টিল ক্রেন। বিশাল-বিশাল এই ক্রেনগুলোর সাহায্যেও পাথরগুলো তোলার সময় এতোটাই পরিশ্রম, ঝক্কি ও সাবধানতার চাপ সইতে হয়েছিলো তাঁদের, যে, তাঁরা একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন হেলিকপ্টার ব্যবহার করার, পাথর তুলতে ও বসাতে। যদিও ব্যবহার করেননি, নীতিবোধে লাগায়।
অবশেষে, যদিও, শেষ পর্যন্ত গিজার 'দ্য গ্রেট পিরামিড'-এর পাশে ১০ মিটার উচ্চতার একটি পিরামিড তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন জাপানের গবেষক দলটি; তথাপি, তাঁরা সহ সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছিলেন─ এই এক্সপেরিমেন্ট সব দিক দিয়েই, সম্পূর্ণভাবে, ব্যর্থ হয়েছে। যেহেতু, একাধিক আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েই তৈরি করতে হয়েছিলো পিরামিডটি।
যার অর্থ: পিরামিড তৈরির কৌশল নিয়ে এপর্যন্ত আমাদের জানা তথ্য ও তত্ত্বে বিভ্রাট আছে, আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি─ কিভাবে, কোন্‌ কৌশলে, কী যন্ত্রপাতির সাহায্যে, কী প্রযুক্তিতে, কীরকম ইঞ্জিনিয়ারিং মেধা ও প্রতিভায়, তৈরি করা হয়েছিলো আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের পিরামিডগুলো! যেহেতু, এরকম একটি পিরামিড তৈরিতে প্রাক্টিক্যালি আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আহ্‌, সেই ফেরাউন-যুগ! কী জ্ঞানের রহস্য লুকিয়ে আছে মহাকালের সেই পৃষ্ঠাগুলোয়? কবে জানবো আমরা?


Share on Google Plus

About somrat

Ut wisi enim ad minim veniam, quis nostrud exerci tation ullamcorper suscipit lobortis nisl ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis autem vel eum iriure dolor in hendrerit in vulputate velit esse molestie consequat, vel illum dolore eu feugiat nulla facilisis at vero eros et accumsan et iusto odio dignissim qui blandit praesent luptatum zzril delenit augue duis.

0 Comments:

Post a Comment